গণমাধ্যম কি? বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমের বর্ণনা

বর্তমানে আমরা সবাই গণমাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত। এখনকার সমাজে গণমাধ্যম একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। তথ্য,সংবাদ,বিনোদন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমের বিকল্প নেই। আমাদের আজকের এই আর্টিকেলে আলোচনা করবো গণমাধ্যম কি,গণমাধ্যমের প্রকারভেদ এবং গণমাধ্যম আমাদের কি সুবিধা-অসুবিধা দিয়ে থাকে।

 

গণমাধ্যম কি?

যে মাধ্যমে জনগণের কাছে সংবাদ,তথ্য,বিনোদন ইত্যাদি পৌছায় সেটাই হচ্ছে গণমাধ্যম। অর্থাৎ গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের জনগণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম। গণমাধ্যম  মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের সেতুস্বরূপ‌।

 

গণমাধ্যম কত ধরনের?

আমাদের আশেপাশে অনেক ধরনের গণমাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে বহুল প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো হচ্ছে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ডিজিটাল মিডিয়া। চলুন জেনে নিই আমাদের এই পরিচিত মিডিয়াগুলোর সম্পর্কে তাহলে গণমাধ্যম কি এই সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পারবো।

 

প্রিন্ট মিডিয়া

প্রিন্ট মিডিয়া মূলত সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বইয়ের মাধ্যমে সংবাদ এবং তথ্য মানুষের কাছে পৌছে দেয়। প্রিন্ট মিডিয়ার মধ্যে সংবাদপত্র সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। অনেক মানুষ বিশ্বস্ত সংবাদ এবং তথ্যের জন্য সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করেন।

 

প্রিন্ট মিডিয়ার অরেকটি উপাদান হচ্ছে ম্যাগাজিন, বিস্তারিত জ্ঞান লাভের জন্য অনেক পাঠক ম্যাগাজিন পছন্দ করেন। কারণ ম্যাগাজিনে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গভীরভাবে আলোচনা করা হয় এবং ম্যাগাজিনে গল্প, কার্টুন, বিনোদনমূলক কন্টেন্ট থাকে। 

 

সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিন ছাড়াও বই পড়তে ভালোবাসেন অনেকেই। জ্ঞান লাভের জন্য বিভিন্ন ধরনের বই পড়া সর্বোত্তম।

 

ইলেকট্রনিক মিডিয়া

ইলেকট্রনিক মিডিয়া হলো রেডিও, টেলিভিশন, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। তবে এসবের মধ্যে বর্তমানে টেলিভিশনই গণমাধ্যম হিসাবে বেশি পরিচিত। টেলিভিশনে বিভিন্ন ফুটেজসহ সংবাদ পরিবেশন করা হয় তাই টেলিভিশনে সংবাদ দেখা সুবিধাজনক। 


রেডিওকে আগে গণমাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হতো কিন্তু বর্তমানে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট এর বদৌলতে রেডিওর ব্যবহার অনেকাংশেই কমে গিয়েছে।

 

ডিজিটাল মিডিয়া গণমাধ্যম

যে মিডিয়া  ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য প্রেরন, তথ্য প্রদর্শন ও সংরক্ষণ করে থাকে সেটাই ডিজিটাল মিডিয়া। এখনকার সময়ে ইন্টারনেট হলো সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম। 

 

ইন্টারনেটে যেকোনো সময় যেকোনো তথ্য পাওয়া যায়। কোনো সংবাদ নিমিষেই চলে যায় সবার কাছে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছে। 

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে যেকোনো অডিও,ভিডিও,টেক্সট মানুষের কাছে খুব দ্রুতই পৌছে যাচ্ছে।

 

গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকা

সংবাদপত্র গণমাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ে অভ্যস্ত। তাদের দিনটি শুরু হয় সংবাদপত্র হাতে নিয়ে। সংবাদপত্রের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো এখানে রাজনৈতিক খবরাখবর, দেশের বিভিন্ন খবরাখবর, আন্তর্জাতিক খবর, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, বানিজ্য, বিনোদন এবং খেলাধুলা সবকিছুর খবরই একসঙ্গে পাওয়া যায়। 

 

এছাড়াও কার্টুন, ধাঁধা, সাক্ষাৎকার এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইটেম থাকে বিনোদনের জন্য যা সব বয়সী মানুষকে আকর্ষণ করে থাকে। সংবাদপত্র বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে যা জনমত গঠনে সহায়তা করে। 

 

আমাদের দেশের কিছু জনপ্রিয় সংবাদপত্র হলো: ‘দৈনিক প্রথম আলো‘, ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’, ‘ দৈনিক ইত্তেফাক’,  ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ ইত্যাদি।

 

গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন এবং রেডিওর ভূমিকা

গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন রেডিওর থেকে বেশিই গুরুত্ব পালন করে। যখন বাংলাদেশে টেলিভিশন ছিলো না বা কম ছিলো তখন মানুষ রেডিওর উপরে নির্ভরশীল ছিলো। কিন্তু প্রায় সবার ঘরে ঘরেই টেলিভিশন আছে এবং অসংখ্য চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করেছে। 

 

গণমাধ্যম মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন জনপ্রিয়তা পাবার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো টেলিভিশনে গুরুত্বপূর্ণ নিউজগুলো লাইভ দেখানো হয়। আর এটি সম্ভব হয়েছে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির ফলে।  এছাড়াও প্রতি ঘন্টায় নিউজ দেখানো হয় এবং বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান,টকশোর আয়োজন করে থাকে।

 

বাংলাদেশের কিছু জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল হচ্ছে ‘যমুনা টিভি’ ‘নিউজ 24’, ‘চ্যানেল আই’, ‘আরটিভি’, ‘এনটিভি’, ‘একাত্তর টিভি’, ‘বাংলাভিশন’, এবং সময় টিভি।

 

কিছু মানুষ এখনো রেডিও শুনেন নিয়মিত। জনপ্রিয় কিছু রেডিও হচ্ছে ‘বাংলাদেশ বেতার’, ‘রেডিও ফুর্তি’, ‘রেডিও টুডে’, ইত্যাদি।

 

বাংলাদেশের গণমাধ্যম

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম রয়েছে। মানুষের ব্যবহারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্র। বাংলাদেশে সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ৩টি, বিটিভি, সংসদ টিভি এবং বিটিভি চট্টগ্রাম । এছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ৪৫ টি, এর মধ্যে সম্প্রচার করছে ৩৫টি। 

 

২০২৩ সালের এক হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে অনুমোদিত দৈনিক সংবাদপত্রের আছে ৫৫১টি।এর মধ্যে ঢাকার শহরে আছে ২৫৪টি এবং ঢাকার বাহিরে ২৯৭টি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে।

 

গণমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক

বাংলাদেশে ব্যবহৃত আরেকটি জনপ্রিয় গণমাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। ২০২৪ সালের জানুয়ারির হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩৯লাখ ৫৫হাজার জন। অর্থাৎ বিশাল একটি জনগোষ্ঠি ফেসবুক নিয়মিত ব্যবহার করে থাকে। 

 

দেখা যায় বর্তমান যেসব টেলিভিশন বা রেডিও চ্যানেলের গণমাধ্যমগুলো রয়েছে সেগুলোর উপর মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা কম। জনগন টেলিভিশনের চেয়ে ফেসবুকের সংবাদকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও ফেসবুকের সংবাদে গুজব ছড়ার সম্ভবনা বেশি থাকে তবুও এটির উপরই মানুষের বিশ্বাস বেশি। 

 

সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, জুলাই, ২০২৪ এ কোটা আন্দলনের সময় সরকার ডাটা সেন্টারে আগুনের কারণ দেখিয়ে ফেসবুক ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সেই সময়ে দেখা যায় মানুষের মধ্যে হাহাকার, তার কাছে রেডিও টেলিভিশন থাকার পরও তার যেন সে কোন খবরই পাচ্ছেনা। 

 

সরকার যখন ইন্টারনেট, ফেসবুক খুলে দিলো তখন যেন মানুষ স্বস্তি ফিরে পেলো। কিছু মানুষ এখন দেশের অবস্থা জানার জন্য ফেসবুক ওপেন করে। তাই বলা যায় বর্তমানে ফেসবুকও গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। 

 

গণমাধ্যমকে আমরা ব্যবহার করি সঠিক তথ্য এবং খবরাখবর পাওয়ার আশায়। কিন্তু অনেক সময়ই আমাদের আশার বিপরীত হয়ে থাকে। গণমাধ্যমের সাহায্য ছাড়া আমরা যেমন চলতে পারি না তেমন এটি কখনো কখনো আমাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। চলুন জেনে নিই গণমাধ্যম আমাদের কি কি সুবিধা দিয়ে থাকে এবং কি কি অসুবিধায় ফেলে।

 

গণমাধ্যম এর সুবিধা

গণমাধ্যমের অনেক ধরনের সুবিধা রয়েছে। একটি দেশের উন্নতির জন্য গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এগুলো আমরা আরো বেশি বুঝতে পারি যখন প্রাকৃতিক কোন দূর্যোগ আঘাত হানে। কয়েকদিন আগে থেকেই মানুষকে সচেতন করা, সেইসাথে কত নম্বর সতর্ক সংকেত এগুলো জানানোর মাধ্যমে মানুষের জান মালের অনেক ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। এছাড়াও এর বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে যেমন: 

 

  • গণমাধ্যম খুব দ্রুত এবং সহজেই যেকোন তথ্য,খবরাখবর জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়। 
  • বিভিন্ন শিক্ষামূলক কন্টেন্ট এবং তথ্যবহুল কন্টেন্ট মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় যা আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করে।
  • বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিশ্লেষণ ও আলোচনা মানুষের মতামত গঠনে সহায়তা করে।
  • নাটক,সিনেমা,গান ইত্যাদি থেকে মানুষ বিনোদন পেতে পারে।
  • বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট মানুষের মনোরঞ্জন করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে।
  • সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ের উপর মত বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে।
  • মানুষের মধ্যে সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি করে।

গণমাধ্যম এর অসুবিধা

  • কোনো উদ্দেশ্যে মিথ্যা এবং বিকৃত সংবাদ প্রচার করতে পারে।
  • অপরাধ এবং অশ্লীল কন্টেন্ট মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • অতিরিক্ত সময় গণমাধ্যম ব্যবহার করার ফলে স্বাভাবিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
  • ইলেকট্রনিক ডিভাইস এর উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যেতে পারে।
  • গণমাধ্যমের উপর আসক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে।

পরিশেষে

অনেক আগে থেকেই গণমাধ্যম আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ছিলো এবং এখনো আছে। কোন ঘটনার কথা শুনলেই আমরা টেলিভিশনের সামনে বসি, অথবা অনলাইন পত্রিকা দেখি অথবা ফেসবুকে চলে যাই বিস্তারিত জানার জন্য। 


পরিশেষে একটি কথা বলবো সংবাদ দেখা বা শোনার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল করা উচিৎ এটি সঠিক কিনা। বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়াতে যেমন কিছু সংবাদগুলো যেমন চরম সত্য হয় যেটা অন্য গণমাধ্যম প্রকাশ করতে সাহস পায়না। 


একইভাবে এখানে গুজবের সম্ভবনাও অনেক বেশি থাকে। তাই আমাদের নিজেদের সচেতন হওয়া দরকার, যে সংবাদ দেখছি এটা কে বললো এটার উৎস কোথায় এগুলো বিবেচনা করে অন্যের সাথে শেয়ার উচিৎ। 


আশা করি এই আর্টিকেলটি থেকে  গণমাধ্যম কি এই সম্পর্কে ধারনা পেয়েছেন। এই আর্টিকেল সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিতে পারেন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন যেকোনো প্রয়োজনে।

Leave a Comment