ডিজিটাল ব্যাংকিং কি? এর সুবিধা এবং নীতিমালাসমূহ

বর্তমান যুগে খুব কম মানুষই আছে যারা ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত না। ইন্টারনেট যেমন আমাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে গেছে তেমনিভাবে ইন্টারনেট কেন্দ্রিক ডিভাসগুলোর ব্যবহারও দিন দিন বেড়েছে এবং এখানো বাড়ছে। এর প্রভাব ব্যাংকিং সেক্টরকেও বাদ রাখেনি। প্রথম দিকের ব্যাংকগুলোতে দেখা যেত একগাদা ফাইল ব্যবহার করে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। কম্পিউটার আবিষ্কারের পর কম্পিউটারের মাধ্যমে সকল হিসাব রাখা হতো। পরবর্তীতে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় অনলাইনেই অনেক সেবা পরিচালনা করা হতো। এখন এটা আরো একধাপ এগিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং এ এসে থেমেছে। এ পর্যায়ে আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিং নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করবো।

 

ডিজিটাল ব্যাংকিং কি

ডিজিটাল ব্যাংকিং হলো এমন একটি ব্যাংকিং পরিষেবা যা অনলাইন বা অ্যাপসের মাধ্যমে সেই সকল সেবা প্রদান করে যা শুধুমাত্র একটি ব্যাংকিং শাখাতেই পাওয়া যেত। 

 

আপনি নিশ্চয় সংজ্ঞা দেখেই বুঝতে পারছেন এই ব্যাংকিং এর সুবিধা কেমন হতে পারে। এটার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সার্ভিস নেবার জন্য আপনাকে ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাড়াতে হবেনা। কোনো একটি লোন নেবার জন্য একগাদা কাগজপত্র নিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হবেনা। এসব কাজ আপনি ঘরে বসেই নিমিষেই করে ফেলতে পারবেন।

 

মোবাইল ব্যাংকিং কি

মোবাইল ব্যাংকিং হলো এমন একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেখানে আপনি ফোনের মাধ্যমেই আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন। আপনি চাইলে কেউ যদি আপনার ফোনে টাকা পাঠায় সেটা টাকা আপনি ক্যাশ তুলতে পারবেন। আবার আপনি যদি কারো ফোনে টাকা পাঠান সেটাও সে ক্যাশ তুলতে পারবে। 

 

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মোবাইল ব্যাংকিং রয়েছে এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউক্যাশ, সিওর ক্যাশ উল্লেখযোগ্য। মোবাইল ব্যাংকিং এর কিছু সুবিধা থাকলেও এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। 

 

যেমন একটা উদাহরণসরূপ যদি বলি আপনি মোবাইল ব্যাংকিং থেকে কোথাও টাকা পাঠানো বা রিসিভ করতে পারছেন। আপনি চাইলেই তাৎক্ষনিক ভাবে বা কোন ভাবেই কিন্তু আপনি মোবাইল ব্যাংকিং থেকে লোন নিতে পারবেননা। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আপনি এসব সুবিধা পেতে পারেন।

 

ডিজিটাল ব্যাংকিং বাংলাদেশ

ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মত দুটি ব্যাংকে ডিজিটাল ব্যাংকিং এর জন্য অনুমোদন দিয়েছে। গত ২২ অক্টোবর তারা নগদ এবং কড়িকে তারা এই অনুমোদন দিয়েছে। তবে তারা ব্যাংক দুটি এখনো তাদের কার্যক্রম শুরু করেনি। 

 

নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি এর সিইও ও এমডি তানভীর এ মিশুক বলেন তাদের ইচ্ছা স্বল্প সময়ে তারা বেশি সংখ্যক মানুষকে নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের আওতায় নিয়ে আসতে চায়। তাদের যেহেতু আগে থেকেই নগদ নামে একটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু আছে এবং এটি মার্কেটে খুব ভালো অবস্থানে আছে তাই তাদের জন্য কাজটা অনেক সহজ হবে। 

 

তিনি বলেন মানুষ এই এর মাধ্যমে ছোট ছোট লোন নিতে পারবে। এর জন্য তার কোন টিন বা ট্রেড লাইসেন্স লাগবেনা যা মানুষকে বাড়তি সুবিধা দিবে। 

 

তাদের টারগেট গ্রামের প্রান্তিক মানুষ পর্যন্তু পৌছানো। যারা এখন ব্যাংকিং সেবা থেকে দূরে আছে, বা বিভিন্ন কারনে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেনা তারাও যেন অতি সহজে নগদ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে সেদিকে জোর দেওয়া। 

 

তিনি আরো বলেন এখানে বিভিন্ন ধরনের লোনের ব্যবস্থা থাকবে।  যেমন কারো ইমারজেন্সি লোন লাগবে যেটা কয়েকদিনের মধ্যেই সে পরিশোধ করতে পারবে। তাহলে সে শুধুমাত্র ঐ কয়দিনের জন্যই লোন নিতে পারবে। তাকে শুধুমাত্র ঐ কদিনের ইন্টারেস্ট দিতে হবে। 

 

এছাড়া তিনি আরো বলেন গ্রামে অনেক মানুষ আছে যারা এখনো মাটির ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। আমাদের টারগেট তারা যেন নগদ ডিজিটাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা জমা রাখে সেই অনুযায়ী কাজ করা।

 

ডিজিটাল ব্যাংকিং এর সুবিধা

আশা করা যাচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংকিং এর গ্রাহক অন্যান্য সাধারণ ব্যাংকের গ্রাহকদের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। এর পিছনে অবশ্যই কিছু কারণ রয়েছে, যেমন ডিজিটাল ব্যাংকিং এর সুবিধা এর মত সুবিধা অন্য ব্যাংক দিতে পারবেনা আর সম্ভবও না। এর অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে নিচে এগুলো উল্লেখ করা হলো:

 

২৪/৭ ব্যবহারযোগ্য

ডিজিটাল ব্যাংকিং এর যে কয়টা বড় সুবিধা রয়েছে তার মধ্যে এটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যে কোনো দিন যে কোনো সময় এবং যে কোনো স্থান থেকেই এই ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন। 

 

আমরা বর্তমানে যে ব্যাংকিং সিস্টেম দেখে থাকি সেখানে দেখা যায় যে ১০ টা থেকে ৪ টা পর্যন্তু সার্ভিস দেয় যেটা আমাদের ব্যাক্তিগত চাকুরীজীবন বা অন্যান্য সময়ের সাথে সাংঘর্ষিক। যার কারণে আমরা চাইলেই যে কোনো সময় সেবা নিতে পারিনা। 

 

কিন্তু যদি ডিজিটাল ব্যাংকিং এর কথা চিন্তা করা হয় তাহলে অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে মানি ব্যাংকিং এর যাবতীয় অ্যাক্সেস আপনি যে কোনো সময় করতে পারবেন।

 

সময় সাশ্রয়

চার্লস ডারউইনের বিখ্যাত একটি উক্তি আছে সেটা হলো “ যে লোক জীবনের একটি ঘন্টা নষ্ট করার সাহস করে, সে আসলে জীবনের মূল্য এখনও বোঝেনি ”। প্রকৃতপক্ষে আমাদের যা কিছুই থাক না কেন তারমধ্যে সময় সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আর এই ডিজিটাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমেই আমরা আমাদের মূল্যবান সময়কে বাঁচাতে পারি। 

 

যে কাজগুলোর জন্য আপনাকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে করা লাগতো যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, চেক বই জমা দেওয়া, লোন এর জন্য আবেদন করা এসব কাজগুলোই এই ব্যাংকিং সিস্টেমে ফোন দিয়ে নিমিষেই ঘরে বসে করে ফেলতে পারবেন।

 

খরচ সাশ্রয়

ডিজিটাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আমরা বিভিন্নভাবে আমরা আমাদের খরচ সাশ্রয় করতে পারি। খরচ সাশ্রয়ের উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো গাড়ি ভাড়া। কোনো ব্যবহারকারি যদি গ্রামে থাকেন তাহলে তাকে গ্রাম থেকে শহরে যেতে হবে বা অনেক দূরে যেতে হবে ব্যাংকিং প্রয়োজন মিটানোর জন্য। কেউ যদি ঢাকা বা শহরেও থাকে তারপরও দেখা যায় তার মিনিমাম একটা রিকশা ভাড়া লেগেই যায়। কিন্তু আমরা এই ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই খরচটি শুন্যের কোটায় নিয়ে আসতে পারি। 

 

এছাড়া ব্যাংক কতৃপক্ষের জন্যও এই খরচ অনেক কমে যায়। একটি সাধারণ ব্যাংকের লাইসেন্স নিতে যেখানে আপনাকে ৫০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জামানত দিতে হয় সেখানে ডিজিটাল ব্যাংকিং এর জন্য ১২৫ কোটিতেই সম্ভব হচ্ছে। 

 

সাধারণ ব্যাংকের জন্য যেমন অনেকগুলো ব্রাঞ্চ অফিস খোলা লাগতো এবং সেখানের যাবতীয় খরচ, কর্মীদের বেতন দিতে হতো। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে একটি প্রধান কার্যালয় দিয়েই সকল সার্ভিস প্রোভাইড করা সম্ভব।

 

ফিনান্সিয়াল মনিটরিং

বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমরা যেমন আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছি ঠিক তেমনিভাবে কিছু অসাধু ব্যক্তির জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্থও হচ্ছি মাঝে মধ্যে। তাই বর্তমান সময়ে আমাদের ব্যাংকিং বিষয়গুলোতে আমাদের মনিটরিং করাটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়েগেছে। 

 

ডিজিটাল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আপনি অতি সহজেই আপনার ব্যাংকিং দিকগুলো মনিটর করতে পারবেন। তারাই আপনাকে নোটিফিকেশন দিয়ে সতর্ক কর দিবে যদি কোনো অনুনমোদিত ব্যক্তি আপনার অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেস করতে চায় বা কোনো প্রতারণামূলক লেনদেন করতে চায়। 

 

গ্রাহক যে কোনো সময় তার ব্যাংকের যাবতীয় তথ্য দেখতে পাবে, লেনদেনের তথ্য দেখতে পাবে ফলে তারজন্য অনেক সুবিধা হবে মনিটরিং করতে।

 

শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা

নিরাপত্তা কে না চায়, সবাই চায় তার সম্পদ নিরাপদে থাকুক। আমরা বাসায় টাকা পয়সা রাখিনা কারণ বাসায় চুরি-ডাকাতির একটা সম্ভবনা থাকে। আমাদের কষ্টের টাকা যেন নিরাপদে থাকে, প্রয়োজনে যেন সেটা ব্যবহার করতে পারি সেই বিশ্বাসেই অর্থ সম্পদ আমরা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখি। সুতরাং এটার নিরপত্তা সবচেয়ে বেশি দরকার। 

 

আপনারা যারা ইতিমধ্যে অনলাইন ব্যাংকিং সার্ভিস ব্যবহার করছেন তারা নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে ব্যাংকিং সেক্টরগুলো সাইবার নিরাপত্তায় বিশেষ জোর দিয়ে থাকে। বিশেষ করে তারা মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন এবং বায়োমেট্রিকের মত ভেরিফিকেশনের মত টেকনোলজি তারা ব্যবহার করে থাকে। 

 

এছাড়াও আপনি যখনই আপনার অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেস করবেন তখনই আপনাকে মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে যে আপনার অ্যাকাউন্ট এ লগইন করা হইছে। কোনো সন্দেহ হলে সয়ংক্রিয় ভাবে অ্যাকাউন্ট লক বা ফ্রিজ করে রাখা হয়, যা আপনার নিরাপত্তাকে আরো শক্তিশালী করে।

 

 

 

ডিজিটাল ব্যাংকিং এর অসুবিধা

এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ডিজিটাল ব্যাংকিং এর অনেক অনেক সুবিধা রয়েছে, পাশাপাশি এটাও ঠিক যে সবকিছুরই ভালো মন্দ দিক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম যে অসুবিধা রয়েছে সেটা হলো বুঝতে অসুবিধা হওয়া। 

 

আপনি যদি কোনো ব্যাংকে গিয়ে থাকেন তবে নিশ্চয় দেখেছেন যে হেল্প ডেস্ক নামে একটি জায়গা আছে। কোনো কিছু না বুঝলে সেখানে গিয়ে বললে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে এভাবে সরাসরি সমস্যা সমাধান করার কোনো উপায় আপাতত থাকছেনা। 

 

উপরন্তু, বিভিন্ন সময় অ্যাকাউন্টের শর্তাবলীর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হতে পারে। যেটা সাধারণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে ব্যাংক ম্যানেজার বা উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করলে মাঝেমধ্যে একটু ছাড় পাওয়া যায়। এই সুবিধাটুকু অবশ্য ডিজিটাল ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে থাকছেনা।

 

ডিজিটাল ব্যাংকিং নীতিমালা

যেহেতু বাংলাদেশে নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকিং সিস্টেম চালু হচ্ছে তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এর জন্য বেশ কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এসকল নীতিমালার উপর নির্ভর করেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং এর জন্য অনুমোদন দিয়ে থাকে। নিচে নীতিমালাগুলা উল্লেখ করা হলো:

 

  • মূলধন লাগবে মিনিমাম ১২৫ কোটি, যেখানে সাধারণ ব্যাংকের জন্য প্রয়োজন ছিলো ৫০০ কোটি

  • ব্যাংকের প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা মূলধন বিনিয়োগ করতে হবে। 

  • ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার পাচঁ বছরে মধ্যে এই ব্যাংককে দেশের শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও বা শেয়ার ছাড়তে হবে। 

  • উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি ও ব্যাংকিং বিষয়ে যথাযথ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকতে হবে

  • কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রচলিত ব্যাংকের মতো সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত নূন্যতম নগদ জমা ও বিধিবদ্ধ জমা বজায় রাখতে হবে

  • কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না।

  • এক পরবার থেকে সর্বোচ্চ কতজন পরিচালক হতে পারবেন, তা ঠিক হবে বাংলাদেশ ব্যাং কোম্পানি আইন অনুযায়ী।

 

এই ছিলো মোটামুটি ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্পর্কিত কিছু কথাবার্তা। আশা করি আপনি ডিজিটাল ব্যাংকিং কি এবং এর সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়েছেন। 

যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

Leave a Comment