পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আমাদের আজকের এই কন্টেন্ট থেকে আমরা জানবো পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোথায় অবস্থিত?
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে অবস্থিত। এটি প্রায় ১হাজার একর জায়গার উপর নির্মিত এবং এটি পায়রা বন্দরের কাছেই।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কোন নদীর তীরে অবস্থিত?
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আন্ধারমানিক নদীর তীরে অবস্থিত।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কারা তৈরি করে?
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির যৌথভাবে মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশ ও চায়না পাওয়ার কোম্পানি ( বিসিপিসিএল)। বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট করপোরেশন এর সমান অংশীদারিত্বে নির্মাণ করা হয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করার চুক্তি হয়। প্রকল্পটি নির্মাণ কাজ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প ব্যায়?
মোট ২৪৮ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এই প্রকল্পটি। এর মধ্যে ১৯৬ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে চীন অর্থাৎ মোট ব্যয়ের বেশিরভাগ অর্থয়নই করেছে চীন।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা কত?
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট। বর্তমানে প্রতিদিন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৭০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কোনটি?
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১হাজার একর জমির উপর স্থাপিত হয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদনে আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে অবস্থান করেছে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুইটি অংশ রয়েছে, এবং দুটি অংশে মোট ৪টি ইউনিট রয়েছে। প্রথম অংশের ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। এই ইউনিটটি ২০২০ সালের মে মাসে বানিজ্যিক ভাবে চালু হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম অংশে ২য় ইউনিটটি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু করে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে ১৩২০টি পায়রা উড়ানো হয়।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রতিদিন প্রায় ১২ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে। এসব কয়লা আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে।
বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা উৎপাদিত বিদ্যুতের থেকে বেশি। তাই পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যে বিদ্যুতের চাহিদার ঘাটতি অনেকাংশেই পূরন করছে এটা নিশ্চিত, এটি অবশ্য একটি ভালো দিক।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা অসুবিধা
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেমন সুবিধা হয়েছে ঠিক তেমনি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কারনে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এখন আমরা আলোচনা করতে চলেছি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দ্বারা আমরা কি সুবিধা পেয়েছি বা পাচ্ছি, এবং এর কারনে কি কি চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হচ্ছি।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা
- পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিয়মিত ৭০০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে যা বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছে।
- বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ার ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন হচ্ছে একইসাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কারনে স্থানীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। সড়ক,যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অসুবিধা
- কয়লা পোড়ানোর কারণে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যন্য গ্যাস নির্গত হচ্ছে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
- বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তাপ, নির্গত ক্ষতিকর পদার্থের কারনে স্থানীয় জীববৈচিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
- বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ এরকম একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, এবং চালিয়ে যাচ্ছে এটি একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপনের কারনে স্থানীয় এলাকায় এবং বাংলাদেশে এর কিছু অর্থনৈতিক, পরিবেশগত প্রভাব লক্ষ করা যায়। চলুন সেই বিষয়গুলো দেখে নেওয়া যাক।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থনৈতিক প্রভাব
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের একটি মেগা প্রকল্প। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎতের উপর নির্ভরশীল শিল্প কারখানাগুলোতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একইসাথে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে,যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। শিল্প কারখানা বাড়ার কারণে কর্মসংস্থান বাড়ছে। এই প্রকল্পটি চীনের সহায়তায় নির্মাণ করা হয়েছে যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হওয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি কিছুটা হলেও কমেছে যা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে কয়লার উপর নির্ভর করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় যার কারনে বায়ুতে গ্যাস নির্গত হয় যা বায়ুর গুণগত মানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে,বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে তাপ ও ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয় যা পানিতে মিশে পানির দূষণ ঘটায়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন রাসায়নিক ও বর্জ পদার্থ স্থানীয় কৃষি ক্ষাতে অবনতি ঘটাতে পারে এবং এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো বিশেষ করে কার্বন ডাই অক্সাইড জলবায়ু পরিবর্তনকে তরান্বিত করে।
পরিশেষে
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিদ্যুৎতের ব্যবহারের গুরুত্ব লিখে শেষ করা যাবেনা। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিদ্যুৎ এর ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরই পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেমন- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তবে যতই বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক না কেন আমাদের প্রত্যেকের উচিত বিদ্যুৎ ব্যবহারে সতর্ক হওয়া এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
আশা করি এই আর্টিকেল থেকে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে পূর্ণ ধারনা পেয়েছেন। আর্টিকেলটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানাতে পারেন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন যেকোনো প্রয়োজনে।