এইযে বর্তমানে আমরা এত দ্রুত গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। এই ইন্টারনেট কোথায় তৈরি হয়েছে এবং কোথায় থেকেই বা আমরা ইন্টারনেট পাচ্ছি সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছি। এই সবই হয়েছে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর উন্নতির ফলে। আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা অপটিক্যাল ক্যাবল এর বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল কাকে বলে
প্রথমেই আমরা জানার চেষ্টা করবো ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল কাকে বলে। ফাইবার অপটিক্যাল হলো এমন একটি প্রযুক্তি যেটার মাধ্যমে স্বচ্ছ কাচেঁর মধ্যে দিয়ে পালস আকারে তথ্য প্রেরণ করা হয়।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল মূলত অনেক বেশি দূরুত্ব এবং উচ্চ পারফরম্যান্স সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্কিং এর জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি এমন একটি উন্নত ক্যাবল যেটি বৈদ্যুতিক তারের চেয়ে দীর্ঘ দূরত্বে উচ্চ ব্যান্ডউইথ এ ডাটা প্রেরণ করতে সক্ষম। যা আধুনিক টেলিযোগাযোগের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলের উপাদান
ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মূলত তিনটি উপাদান রয়েছে যেমন:
কোর: একটি একটি অপটিক্যাল ক্যাবলের কেন্দ্রিয় টিউব। এর মূল ব্যাস প্রায় 5um থেকে 100um পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ক্লাডিং: এটি কোরকে আবৃত করে রাখার জন্য বাইরের একটি আবরণ। কোর থেকে আলো প্রতিফলিত হবার সময় যেন বাইরে না আসে এজন্য এটি দেওয়া থাকে।
বাফার কোটিং: এটি সম্পূর্ণ বাইরের আবরণ যা সিলিকন রাবারের তৈরি ফাইবারকে সুরক্ষিত রাখে। এর বাইরের আবরণের ব্যাস হলো প্রায় 250 থেকে 300um।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর প্রকারভেদ
ফাইবার অপটিক ক্যাবলকে ২ভাগে ভাগ করা যায় যেমন সিঙ্গেল মোড ফাইবার এবং মাল্টি মোড ফাইবার।
সিঙ্গেল মোড ফাইবার: সিঙ্গেল মোড ফাইবারে শুধুমাত্র একধরনের আলোক রশ্মি ফাইবারের মাধ্যমে চলতে পারে। এই ধরণের ফাইবারের ছোট কোরের ব্যাস 5um এবং উচ্চ কোরের ব্যাস 70um হয়ে থাকে। এবং এই ক্যাবলের ক্ষেত্রে এর আলোর প্রতিসারঙ্ক ইনডেক্স অনেক কম হয়ে থাকে।
এই ক্যাবলের মধ্য দিয়ে চলার সময় আলোর কোন বিচ্ছরণ হয়না অর্থাৎ সংকেতের কোনো অবনতিও হয়না। একটি লেজার ডায়োডের মাধ্যমে আলো প্রবাহিত হয়।
মাল্টি মোড ফাইবার: মাল্টি মোড ফাইবারে আলোক রশ্মি যাওয়ার জন্য অনেকগুলি মোড ব্যবহার করতে পারে। এর মূল ব্যাস সাধারণত 40um এবং এর ক্ল্যাডিং এর ব্যাস 70um হয়। এর প্রতিসরণ সূচকের পার্থক্য একক মোডের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
মাল্টিমোডে বিচ্ছুরণের কারণে সিগন্যাল অবনতি হওয়ারও সম্ভবনা থাকে। এইক্ষেত্রে বড় সিগন্যালের বড় বিচ্ছুরণ এবং অবনতি হওয়ার কারণে দূরের যোগাযোগের জন্য এটি উপযুক্ত নয়।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল কিভাবে কাজ করে
একটি ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলে এক বা একাধিক কাচেঁর স্ট্র্যান্ড থাকে। যা মানুষের চুল বা তার চেয়ে হালকা মোটা হয়ে থাকে।
প্রতিটি স্ট্র্যান্ড এর কেন্দ্রকে কোর বলা হয়, যার মাধ্যমে আলো তার নির্ধারিত পথে চলতে পারে। কোরটি ক্ল্যাডিং নামক কাঁচের একটি লেয়ার দ্বারা আবৃত করা থাকে। যেন এটি কোনো প্রকার সিগন্যাল লস না করে প্রতিফলিত হয়ে বাঁকা তারের মধ্যে দিয়েও যেতে পারে।
যখন ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মধ্য দিয়ে আলোক সংকেত পাঠানো হয় তখন এটি জিগ-জ্যাগ বাউন্স আকারে প্রতিফলিত হয়ে এগোতে থাকে। তবে ফাইবার অপটিকে সিগন্যালগুলি আলোর গতিতে চলেনা বরং এটি আলোর গতির চেয়ে ৩০শতাংশ কম গতিতে চলে।
ফাইবার অপটিক্যাল এর মাধ্যমে যখন সিগন্যালকে অনেক দূরে পাঠানো হয় সেক্ষেত্রে সিগন্যাল কিছুদূর পর গিয়ে দূর্বল হয়ে যায়। তবে এই সমস্যা দূর করা হয় রিপিটার এর মাধ্যমে। রিপিটারের মাধ্যমে সিগন্যালকে রিনিউ করা হয়।
এই রিপিটারগুলির মাধ্যমে অপটিক্যাল সিগন্যালকে ইলেকট্রিক সিগন্যালে রূপান্তর করা হয়। এবং পরবর্তীতে এই ইলেকট্রিক সিগন্যালকে প্রসেস করে স্থানান্তর করা হয়।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর সুবিধা
বর্তমানে এই ক্যাবল অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কেননা ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর অনেক সুবিধা রয়েছে যার কারণে সবাই এই ক্যাবল ব্যাবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। চলুন ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর সুবিধাসমূহ সম্পর্কে জেনে নেই।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর প্রধান সুবিধা হলো এটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন। একটি ফাইবার ক্যাবল যে পরিমাণ নেটওয়ার্ক ব্যান্ডউইথ সহজেই বহন করতে পারে, তা একই পুরুত্বের তামার তারের চেয়েও অনেক বেশি। বিভিন্ন রেটেড ফাইবার ক্যাবল পাওয়া যায় যেমন ১০জিবিপিএস, ৪০জিবিপিএস এবং ১০০ জিবিপিএস।
কোন প্রকার সিগন্যাল বুস্ট ছাড়াই সিগন্যাল অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে।
এই ক্যাবলগুলিতে চলমান সিগন্যালগুলি বাইরের সিগন্যাল থেকে অনেকটা মুক্ত থাকে। যেমন বাইরের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলতে পারে।
এই ক্যাবলগুলি পানির মধ্য দিয়েও যেতে পারে। এতে করে ক্যাবলের কোন প্রকার ক্ষতি হয়না।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলগুলি সাধারণত তামার তারের চেয়ে শক্তিশালী, পাতলা এবং হালকা ধরনের হয়ে থাকে।
এই ক্যাবলগুলিকে খুব বেশি মেইনটেইন এবং প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পরেনা।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর অসুবিধা
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর যেমন অনেক ধরনের সুবিধা রয়েছে তেমনি এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। চলুন এর অসুবিধাসমূহ সম্পর্কে জেনে আসি।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলের দাম সাধারণত তামার ক্যাবলের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলকে অন্য ক্যাবলের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজন পরে।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলকে প্রথমবার ইনস্টল করার ক্ষেত্রে শ্রম এবং খরচ বেশি হয়ে থাকে।
এই ক্যাবল সাধারণত ভঙ্গুর হয়ে থাকে। অর্থাৎ ক্যাবলটিকে নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁকে গেলেই ভেঙ্গে যেতে পারে এবং সিগন্যাল হারিয়ে যেতে পারে।
অপটিক্যাল ফাইবার এর ব্যবহার সমূহ
নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুত সংযোগের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার হয়ে থাকে।
কম্পিউটার নেটওয়ার্কি
এই ক্যাবলের উচ্চ ক্ষমতার কারণে কম্পিউটারের নেটওয়ার্কিং এর ক্ষেত্রে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়াও ফাইবার ক্যাবল প্রায়ই ব্রডকাস্টিং এর ক্ষেতে আরো উন্নত সেবা দিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ইন্টারনেট এবং ক্যাবল টেলিভিশন
ইন্টারনেট এবং ক্যাবল টেলিভিশনের জন্য অপটিক্যাল ক্যাবলের ব্যবহার খুবই সাধারণ হয়ে গিয়েছে। দূরবর্তী সংযোগের জন্য এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সমুদ্রের নিচ দিয়ে সিগন্যাল পাঠানো
ফাইবার ক্যাবলগুলি আরো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে ব্যবহার করা যায়। সমুদ্রের নিচ দিয়ে সিগন্যাল পাঠানোর ক্ষেত্রে ফাইবার অপটিক্যাল ব্যবহার করা হয়। কেননা এগুলো একবার সেট করলে বার বার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়না।
সামরিক ক্ষেত্রে
সামরিক ক্ষেত্রেও ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংকেত পাঠানো রিসিভ বা তাপমাত্রা সংবেদন করার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা হয়।
মেডিক্যালে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল এর প্রয়োজনীয়তা
অপটিক্যাল ফাইবারের জনপ্রিয়তার কারণে বর্তমানে এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি বর্তমানে ক্রমবর্ধমানভাবে বায়োমেডিক্যাল সেন্সরগুলির উন্নতিতে অবদান রাখছে। ফলস্বরূপ চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও ব্যপক উন্নতি সাধন হচ্ছে।
ফাইবার অপটিকের সাহায্যে চলমান অন্যান্য মেডিকেল অ্যাপ্লিকেশনগুলির মধ্যে রয়েছে X-ray, endoscopy, light therapy এবং surgical microscopy।
পরিশেষে
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। পূর্বে যেখানে ইন্টারনেট লাইনের জন্য cat-6 ক্যাবল ব্যবহার করা হতো এখন সেখানে ফাইবার ক্যাবল ব্যবহার করা হয়। এতে ইন্টারনেটের স্পিডও ভালো থাকে।
এই ছিলো আমাদের আজকের ফাইবার ক্যাবল সম্পর্কিত আর্টিকেলটি। আশা করি এই ক্যাবল সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছেন। যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।