বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি? বাইনারি সংখ্যার বেসিক অপারেশন

সংখ্যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যা ছাড়া আমরা প্রায় কিছুই কল্পনা করতে পারি না। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে সংখ্যা ব্যবহার করি, সেটি হল দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি, যা দশটি অঙ্ক (০-৯) নিয়ে গঠিত। তবে কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসগুলো সংখ্যার জন্য একটি ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেটিকে আমরা “বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি” বলে থাকি। এই কনটেন্টে আমরা সহজ ভাষায় বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি, এটি কীভাবে কাজ করে এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি হল একটি গাণিতিক সংখ্যা পদ্ধতি যেখানে কেবল দুটি অঙ্ক (০ এবং ১) ব্যবহার করা হয়। এটি দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির মতই একটি সংখ্যা পদ্ধতি, তবে এখানে ১০টির পরিবর্তে ২টি অঙ্ক রয়েছে।

দশমিক সংখ্যা পদ্ধতিতে আমরা যেভাবে ১০টি অঙ্ক ব্যবহার করি (০-৯), বাইনারি পদ্ধতিতে কেবল ০ এবং ১ এই দুটি অঙ্ক দিয়ে সব সংখ্যা প্রকাশ করা হয়।

বাইনারি পদ্ধতির প্রতিটি অঙ্ককে বলা হয় “বিট”। একাধিক বিট একত্রিত হয়ে একটি সংখ্যা তৈরি করে। যেমন, ১০১ বাইনারি সংখ্যাটি একটি তিন বিটের সংখ্যা।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির গঠন

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি বোঝার জন্য আমাদের বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির গঠন সম্পর্কে জানতে হবে। বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ২ বেস নিয়ে কাজ করে, যা ২ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। একে ডুয়েল সংখ্যা পদ্ধতি বলেও উল্লেখ করা হয়। দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির মতই এখানে প্রতিটি বিটের একটি মান থাকে, তবে পার্থক্য হল এখানে প্রতিটি বিটের মান ২-এর ঘাত হিসেবে বেড়ে চলে।

উদাহরণ:

দশমিক সংখ্যাটি ৬ (ডেসিমাল বা ১০ ভিত্তিক) হলে এর বাইনারি রূপটি হবে ১১০ (২ ভিত্তিক)। এবার আসুন দেখি কিভাবে দশমিক সংখ্যা থেকে বাইনারিতে রূপান্তর করা যায়।

দশমিক সংখ্যা থেকে বাইনারিতে রূপান্তর

বাইনারি পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে আমরা এটি দশমিক সংখ্যা থেকে রূপান্তর করতে পারি এবং এর বিপরীত প্রক্রিয়াও করতে পারি। নিচে দশমিক সংখ্যা ৬ কে বাইনারি সংখ্যায় রূপান্তর করার পদ্ধতি দেখানো হল:

ধাপ ১:

দশমিক সংখ্যা ৬-কে ২ দিয়ে ভাগ করতে হবে।

৬ ÷ ২ = ৩ (ভাগশেষ ০)

ধাপ ২:

৩-কে আবার ২ দিয়ে ভাগ করতে হবে।

৩ ÷ ২ = ১ (ভাগশেষ ১)

ধাপ ৩:

১-কে আবার ২ দিয়ে ভাগ করতে হবে।

১ ÷ ২ = ০ (ভাগশেষ ১)

এখন, আমাদের ভাগশেষ গুলি হলো ১১০ অর্থাৎ এটি শেষ থেকে গণনা করতে হবে। 

আরেকটি উদাহরণ:

দশমিক সংখ্যা ১০ (১০ ভিত্তিক) এর বাইনারি রূপ:

১০ ÷ ২ = ৫ (ভাগশেষ ০) 

৫ ÷ ২ = ২ (ভাগশেষ ১) 

২ ÷ ২ = ১ (ভাগশেষ ০) 

১ ÷ ২ = ০ (ভাগশেষ ১)

 

তাহলে, দশমিক ১০-এর বাইনারি রূপ হবে ১০১০।

বাইনারি সংখ্যা থেকে দশমিক সংখ্যায় রূপান্তর

বিপরীত প্রক্রিয়াটি আরও সহজ। এখানে প্রতিটি বিটের অবস্থান অনুযায়ী তার মান বের করা হয়, এবং সেগুলোর যোগফল বের করে দশমিক সংখ্যা পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে ১০১০ (বাইনারি) থেকে দশমিক সংখ্যা বের করার প্রক্রিয়া দেখানো হল:

১০১০ বাইনারি থেকে ডেসিমাল

১*২^৩+০*২^২+১*২^১+০*২^০

= ৮+০+২+০

১০

অর্থাৎ, ১০১০ বাইনারি সংখ্যাটি দশমিক ১০।

বাইনারি সংখ্যার বেসিক অপারেশন

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন রয়েছে: যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগ। এগুলো আমাদের পরিচিত দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির মতোই কাজ করে, তবে এখানে কেবল দুটি সংখ্যা (০ এবং ১) নিয়ে কাজ করা হয়। আসুন, এই অপারেশনগুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করি।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে যোগ (Addition)

বাইনারি যোগ করা অনেকটা দশমিক যোগের মতো, তবে নিয়মগুলো একটু ভিন্ন। 

০ + ০ = ০, 

১ + ০ = ১, 

১ + ১ = ১০ 

 

(যেখানে ২ লিখতে গিয়ে আমরা ০ লিখে ১ ক্যারি করি)। উদাহরণস্বরূপ, ১০১ (বাইনারি) এবং ১১ (বাইনারি) যোগ করলে হয় ১০০০ (বাইনারি)।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে বিয়োগ (Subtraction)

ধরা যাক, আমরা ১১০ থেকে ১০১ বিয়োগ করতে চাই। 

প্রথমে ডানদিক থেকে শুরু করি। প্রথম কলামে ( ০ – ১ ) করা যাবে না, তাই বামপাশের কাছের কলাম থেকে একটি ‘১’ ধার নিতে হবে। ধার নেওয়ার পর প্রথম কলামে ( ১০ – ১ = ১ ) হবে (এখানে ‘১০’ মানে ২)। এরপরের কলামে এখন ‘০’ থাকবে, কারণ ধার দেওয়া হয়েছে, আর উপরের সংখ্যাটি ‘০’, তাই ( ০ – ০ = ০ ) হবে। তৃতীয় কলামে উপরে ‘১’ এবং নিচে ‘১’ আছে, তাই ( ১ – ১ = ০ ) হবে। 

তাহলে, ফলাফল হবে ( ০০১ ), যা মূল সংখ্যা থেকে বিয়োগের পরে পাওয়া যায়।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে গুণ (Multiplication)

বাইনারি গুণে ০ × ১ = ০ এবং ১ × ১ = ১। দশমিক গুণের মতোই, আমরা একে একে বিটগুলো গুণ করি এবং যোগ করি।

ধরা যাক, আমরা ১০১ (ডেসিমাল ৫) এবং ১১ (ডেসিমাল ৩) বাইনারি সংখ্যার গুণ করতে চাই। প্রথমে, ১০১ সংখ্যাকে ১১ এর প্রতিটি সংখ্যার সাথে গুণ করতে হবে।

প্রথম ধাপে, ১০১ সংখ্যাকে নিচের প্রথম ‘১’ এর সাথে গুণ করলে, একই সংখ্যা ১০১ পাই। এরপর, পরের ‘১’ (যা বামপাশে এক ধাপ সরানো অবস্থায়) এর সাথে ১০১ গুণ করলে পাই ১০১০ (এক ধাপ বামে সরানো অবস্থায়)। এখন দুটি সংখ্যা যোগ করলে পাই ১১১১, যা দশমিক ১৫ এর সমান।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে ভাগ (Division)

বাইনারি ভাগের নিয়মও দশমিক ভাগের মতো, তবে এখানে কেবল ০ এবং ১ থাকে। ধাপে ধাপে বিট ভাগ করে ভাগফল বের করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১০১০ কে ১০-এ ভাগ করলে পাই ১০১।

 

এই অপারেশনগুলো কম্পিউটারের ভেতরের কার্যপ্রণালীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ সব তথ্য ও প্রক্রিয়া এই বাইনারি অপারেশনগুলো ব্যবহার করেই সম্পন্ন হয়।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি এটা বোঝার জন্য এর ব্যবহারটাও জানা আমাদের জন্য জরুরী।  বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এর ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত।

বিশেষ করে কম্পিউটার এবং ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অপরিহার্য। আসুন, সহজভাবে বুঝে নেই, বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহারগুলো কী কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ।

১. কম্পিউটার সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি হলো কম্পিউটারের ভাষা। কম্পিউটার তার সমস্ত কাজ ০ এবং ১ দিয়ে করে। কম্পিউটারের প্রসেসর, মেমোরি, এবং স্টোরেজ সবকিছুই এই ০ এবং ১-এর মাধ্যমে তথ্য প্রসেস করে। 

যে কোনো ইনপুট বা কমান্ড যখন আমরা কম্পিউটারে দিই, তখন তা বাইনারি সংখ্যায় রূপান্তরিত হয় এবং তারপর কম্পিউটার সেটিকে প্রক্রিয়া করে। তাই, বাইনারি সংখ্যা ছাড়া কম্পিউটার কার্যকরভাবে কাজ করতে পারত না।

২. ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যবহৃত হয়

আমরা প্রতিদিন যেসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করি, যেমন স্মার্টফোন, টিভি, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি, সেগুলোর ভেতরে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ডিভাইসগুলোর ইলেকট্রনিক সার্কিটে বিদ্যুতের প্রবাহ থাকে, যা কেবল দুটি অবস্থা (অন/অফ) নির্দেশ করতে পারে। 

এই দুই অবস্থাই বাইনারি সংখ্যার ০ এবং ১ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা টিভি চালু করি বা বন্ধ করি, তখন সেই কাজটি বাইনারি পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

৩. ডাটা ট্রান্সমিশন এবং নেটওয়ার্কিং

ইন্টারনেটে বা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্য পাঠানো বা গ্রহণ করার সময়ও বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ডেটা বা ফাইল, চিত্র, ভিডিও, অডিও ইত্যাদি, সবকিছুই বাইনারি সংখ্যায় কনভার্ট করে পাঠানো হয়।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন ইমেইল পাঠাই বা ভিডিও কল করি, তখন তথ্যগুলো আসলে বাইনারি কোড হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয় এবং ট্রান্সমিট করা হয়।

৪. প্রোগ্রামিং ভাষা এবং সফটওয়্যারে ব্যবহার

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি অনেক প্রোগ্রামিং ভাষার ভিত্তি। যদিও আমরা প্রোগ্রামিং ভাষায় উচ্চ স্তরের কোড (যেমন Python, C, Java) লিখি, কিন্তু সেই কোডগুলো শেষ পর্যন্ত বাইনারি কোডে রূপান্তরিত হয় এবং কম্পিউটার তা প্রক্রিয়া করে।

অর্থাৎ, আমাদের কোড এবং সফটওয়্যারগুলি কম্পিউটারের জন্য বোঝার উপযোগী করতে বাইনারি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

৫. গণনা ও গাণিতিক ক্রিয়ায় বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার

ক্যালকুলেটর থেকে শুরু করে উন্নত মাইক্রোপ্রসেসর পর্যন্ত সব জায়গায় গাণিতিক গণনা বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়। ডিজিটাল ক্যালকুলেটরগুলি যখন কোনো সংখ্যা যোগ, বিয়োগ, গুণ বা ভাগ করে, তখন সেই সংখ্যাগুলো বাইনারি কোডে রূপান্তরিত হয় এবং গণনা শেষে আবার তা দশমিক আকারে দেখায়।

৬. ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং সিকিউরিটি সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ক্রিপ্টোগ্রাফিতে (তথ্য নিরাপত্তা) ব্যবহৃত হয়। অনেক নিরাপত্তা সিস্টেম এবং এনক্রিপশন অ্যালগরিদম বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। আমাদের ইন্টারনেট ব্যাংকিং, পাসওয়ার্ড সুরক্ষা এবং অন্যান্য ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বাইনারি কোডের মাধ্যমে তথ্য এনক্রিপ্ট করা হয়, যাতে কেউ সহজে সেই তথ্য চুরি করতে না পারে।

৭. অ্যাডভান্সড টেকনোলজিতে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি শুধু সাধারণ ডিভাইসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আরও অনেক জটিল প্রযুক্তিতেও ব্যবহৃত হয়, যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), রোবোটিক্স, এবং মেশিন লার্নিং। এসব প্রযুক্তি তাদের ডেটা এবং অ্যালগরিদম প্রক্রিয়া করতে বাইনারি কোড ব্যবহার করে।

বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার আধুনিক প্রযুক্তি ও কম্পিউটার সিস্টেমের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উপস্থিত, যেখানেই ডিজিটাল ডিভাইস বা কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়।

সুতরাং, বলা যায় যে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি না থাকলে আমাদের ডিজিটাল যুগের অগ্রগতি সম্ভব হত না। আশা করি এই ব্যবহারগুলির মাধ্যমে আপনি বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি এই সম্পর্ক জানতে পেরেছেন।

পরিশেষে

পরিশেষে বলা যায়, বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি হল আধুনিক কম্পিউটার এবং ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ভিত্তি। সহজ দুটি সংখ্যা (০ এবং ১) ব্যবহার করে, আমরা সমস্ত জটিল ডেটা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে সক্ষম। এই পদ্ধতি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলেছে, এবং এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আশা করি এই আপনি বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি কি এই সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এছাড়াও কোন কিছু জানতে বা আপনার মন্তব্য জানাতে নিচে কমেন্ট বা যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা চেষ্টা করবো আপনাকে সহযোগিতা করার। 

Leave a Comment