কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংতথ্য প্রযুক্তি

ব্লকচেইন কি? ব্লকচেইন কিভাবে কাজ করে

বর্তমানে তথ্য সংরক্ষণ এবং তথ্য স্থানান্তরের জন্য ব্লকচেইন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিগত কয়েক বছরে এই ব্লকচেইন মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। আজ আমরা এই আর্টিকেলে ব্লকচেইন কি এই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো। চলুন তাহলে শুরু করা যাক:

 

ব্লকচেইন কি

ব্লকচেইন হলো একটি উন্নত ডাটাবেজ প্রক্রিয়া যা একটি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কে সচ্ছ তথ্য আদান-প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়। একটি ব্লকচেইন ডাটাবেজ এর ব্লকে ডাটা স্টোর থাকে এবং একটির সাথে আরেকটি চেইন আকারে সংযুক্ত থাকে। 

 

ব্লকচেইনের ডাটাগুলো এমনভাবে স্টোর থাকে যে আপনি চাইলেও এটি সহজে মুছে ফেলতে পারবেন না। বলা যায় এখন পর্যন্ত যতগুলো তথ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে তার মধ্যে নিরাপদ এবং কার্যকরী পদ্ধতি হলো ব্লকচেইন টেকনোলজি।

 

ব্লকচেইন কেন গুরুত্বপূর্ণ

একটি ব্যবসা চলেই তথ্যের উপর। যে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের কাছে যত বেশি এবং নির্ভুল তথ্য সে তত মার্কেট অ্যানালাইসিস করতে পারে। এতে করে তার পণ্যের চাহিদা পরিমাপ করে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করতে পারে। তাই যত তথ্য দ্রুত পাওয়া যায় এবং সেটা যত নির্ভুল হয় ততই ভালো।

 

তাই এই পরিপেক্ষিতে  ব্লকচেইন টেকনোলজি আদর্শ মডেল হতে পারে। কেননা এটি আমাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকে যা একটি অপরিবর্তনীয় লেজারে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। এবং এটি অনুমোদিত নেটওয়ার্ক সদস্যরা ছাড়া কেউ অ্যাক্সেস করতে পারেনা। 

 

একটি ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক অর্ডার, পেমেন্ট, অ্যাকান্ট, উৎপাদন ছাড়া অনেক কিছু ট্র্যাক করতে পারে। আপনি যেকোন সময় একটি লেনদেনের শেষ থেকে শেষ অবধি সমস্ত বিবরণ দেখতে পারেন। যা আপনাকে আরো বেশি আত্মবিশ্বাস যোগায়।

 

ব্লকচেইন কিভাবে কাজ করে

ব্লকচেইন কি এ সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ব্লকচেইন আসলে কিভাবে কাজ করে।  আপনি হয়তো গুগল শিট বা ডাটাবেজের কথা জেনে থাকবেন। একটি ব্লকচেইন টেকনোলজিও কিছুটা অনুরূপ। এটিও একটি ডাটাবেজ যেখানে তথ্য জমা রাখা হয়। কিন্তু ডাটাবেজের সাথে এর মূল পার্থক্য হলো এর স্ট্রাকচার এবং অ্যাক্সেসযোগ্যতা। 

 

ব্লকচেইন স্ক্রিপ্ট নামক কিছু প্রোগ্রাম নিয়ে গঠিত যা ডাটাবেজ সংক্রান্ত কাজগুলি পরিচালনা করে। যেমন তথ্য প্রবেশ করানো, অ্যাক্সেস করা এবং কোথায় সংরক্ষণ হবে তা নির্ধারণ করা। ব্লকচেইনে একটি তথ্য অনেকগুলো কপি করে অনেকগুলি মেশিনে সংরক্ষণ করে রাখা হয় এবং এগুলো নির্ভুল এবং ভ্যালিড হয়ে থাকে। 

 

ব্লকচেইন ট্রানজেকশনের সকল তথ্য সংগ্রহ করে থাকে এবং এটি ব্লকে জমা থাকে, স্পেডশিটের ক্ষেত্রে তথ্য সেল এ যেমন থাক্যে। যদি এটা পূর্ণ হয়ে যায় তবে এনক্রিপ্ট অ্যালগরিদমের মাধ্যমে হ্যাশ নামে একটি হেক্সডেসিমেল সংখ্যা তৈরি করা হয়। 

 

তারপর হ্যাশটি ব্লক হেডারে প্রবেশ করানো হয় এবং ব্লকের অন্যান্য তথ্যের সাথে এনক্রিপ্ট করা হয়। এভাবে একটির পর আরেকটি ব্লক চেইন আকারে সংযুক্ত করা হয়।

 

ব্লকচেইন কত প্রকার

ব্লকচেইন মূলত চার প্রকার। ব্লকচেইন কি এ সম্পর্কে জানতে আমাদের এই চার প্রকার ব্লকচেইন সম্পর্কেও জানতে হবে। ব্লকচেইন এর প্রকারভেদগুলো হলো:

 

  1. পাবলিক ব্লকচেইন

  2. প্রাইভেট ব্লকচেইন

  3. হাইব্রিড ব্লকচেইন

  4. কনশর্টিয়াম ব্লকচেইন।

 

এবার চলুন আমরা ব্লকচেইন কি এর ক্ষেত্রে এই চার প্রকার ব্লকচেইন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। 

 

পাবলিক ব্লকচেইন

ব্লকচেইনের ক্ষেত্রে প্রথম ব্লকচেইন হলো পাবলিক ব্লকচেইন। এই ব্লকচেইনগুলি বিকেন্দ্রীকরণ আইডিয়া অনুসরণ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে ওপেন থাকে। এদের আসলে কোনো রেস্ট্রিকশন নেই, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটে থাকা যে কেউ এই নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণ করতে পারে। 

 

  • নামটি পাবলিক হওয়ায় এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, অর্থাৎ এটি কারো মালিকানাধীন নয়। 

  • নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত সকল কম্পিউটার উপস্থিত অন্যান্য নোড বা ব্লকের এর কপি স্টোর করে রাখে। 

  • এই পাবলিক ব্লকচেইনে আমরা ট্রানজেকশন বা রেকর্ড ভেরিফিকেশনও করতে পারি।

 

পাবলিক ব্লকচেইন এর সুবিধা

বিশ্বাসযোগ্যতা: এটিতে জালিয়াতি শনাক্ত করার জন্য অ্যালগরিদম রয়েছে। তাই অংশগ্রহণকারিদের নেটওয়ার্কের অন্যান্য নোড সম্পর্কে চিন্তা করতে হবেনা। 

 

নিরাপত্তা: এই ব্লকচেইনটি আকারে বড় কারণ এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তাই এখানে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। 

 

বেনামী প্রকৃতি: একই সময়ে লেনদেন করার জন্য এটি একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম, অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাকে নাম পরিচয় প্রকাশ করতে হবেনা। 


বিকেন্দ্রীকৃত: এটি নির্দিষ্ট কোন একটি জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়না, এর পরিবর্তে এটি প্রতিটি ব্যবহারকারীর কাছেই একটি কপি থাকে।

 

পাবলিক ব্লকচেইন এর অসুবিধাসমূহ

প্রসেসিং: এটি বড় আকারে হবার কারণে এর ট্রানজেকশন প্রক্রিয়ার হার খুবই ধীরগতির। কেননা প্রতিটি নোড যাচাইকরণ একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। 

 

পাওয়ার খরচ: পাবলিক ব্লকচেইনে এনার্জি খরচ একটু বেশি প্রয়োজন। কেননা নেটওয়ার্কে অংশগ্রহন করার জন্য ভালো মানের কম্পিউটারের প্রয়োজন পড়ে। 

 

গ্রহণযোগ্যতা: কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই তাই প্রযুক্তিটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

 

প্রাইভেট ব্লকচেইন

এই ব্লকচেইনগুলি ততটা বিকেন্দ্রীভূত নয় যতটা না পাবলিক ব্লকচেইনে থাকে। আর এই বৈশিষ্টটি এই ব্লকচেইনকে আরো নিরাপদ করে তোলে। 

 

  • এগুলো পাবলিক ব্লকচেইনের মত উন্মুক্ত নয়

  • এটি শুধুমাত্র কিছু অনুমোদিত ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত

  • এই ব্লকচেইনগুলি একটি ক্লজড নেটওয়ার্কে পরিচালিত হয়

 

প্রাইভেট ব্লকচেইনের সুবিধা

  • গতি: আকার ছোট হবার কারণে লেনদেনের হার বেশি। প্রতিটি নোডের ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনের কম সময় প্রয়োজন হয়। 
  • পরিমাপযোগ্যতা: এর স্কেলেবিলিটি পরিবর্তন করা সম্ভব, এছাড়া নেটওয়ার্কের আকারের ক্ষেত্রে ম্যানুয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে

  • প্রাইভেসি: এই সিস্টেমে প্রাইভেসির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। 

  • সামঞ্জস্যপূর্ণ: এটি অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ কারণ শুধুমাত্র ব্যবহারকারীদেরই ট্রানজেকশন অ্যাক্সেস রয়েছে যা নেটওয়ার্ক কার্যক্ষমতাকে উন্নত করে।
 

প্রাইভেট ব্লকচেইনের অসুবিধা

  • নিরাপত্তা: এখানে নোডের সংখ্যা সীমিত তাই এটিতে ম্যানিপুলেশনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বলা যায় এই ব্লকচেইনগুলি আরো দূর্বল। 

  • গণনা: যেহেতু এই সিস্টেমে কয়েকটি নোড রয়েছে তাই এটি অফলাইনে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেক্ষেত্রে ব্লকচেইনে পুরো সিস্টেম বিপন্ন হতে পারে।
 

হাইব্রিড ব্লকচেইন

হাইব্রিড ব্লকচেইন সাধারণত পাবলিক আর প্রাইভেট ব্লকচেইনের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়। যেখানে কিছু অংশ কিছু অর্গানাইজেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং অন্যান্য অংশগুলো পাবলিক ব্লকচেইন হিসেবে দৃশ্যমান থাকে। 

 

  • এটি পাবলিক এবং প্রাইভেট উভয় ব্লকচেইনের সংমিশ্রণ

  • এটি অনুমতি ভিত্তিক এবং অনুমতিহীণ সিস্টেম ব্যবহার করা হয়

  • স্মার্ট চুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারী তথ্য অ্যাক্সেস করে

 

হাইব্রিড ব্লকচেইনের সুবিধাসমূহ

  • ইকোসিস্টেম: এই ব্লকচেইনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি হাইব্রিড প্রকৃতির। এটি হ্যাক করা যাবেনা কারণ এখানের ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫১ শতাংশেরই নেটওয়ার্কে অ্যাক্সেস নেই। 

  • খরচ: ট্রানজেকশন অনেকটা সস্তা কারণে এখানে কয়েকটি নোড শুধুমাত্র ট্রানজেকশন ভেরিফিকেশন করে। 

  • আর্কিটেকচার: এটি অত্যন্ত কাস্টমাইজযোগ্য এবং এখনও অখণ্ডতা, নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
 

হাইব্রিড ব্লকচেইনের অসুবিধাসমূহ

  • দক্ষতা: সবাই হাইব্রিড ব্লকচেইন বাস্তবায়নের অবস্থানে নেই। প্রতিষ্ঠানগুলি ব্লকচেইনের মেইনটেন্যান্সের ক্ষেত্রেও বেশি কিছু অসুবিধার সম্মুখিন হয়। 

  • স্বচ্ছতা: এটির এমন একটি সম্ভবনা আছে যে কেউ ব্যবহারকারীর কাছ থেকে তথ্য গোপন করতে পারে। যদি কেউ হাইব্রিড ব্লকচেইনের মাধ্যমে অ্যাক্সেস পেতে চায় তবে এটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করবে। যদি প্রতিষ্ঠান চায় তবে অ্যাক্সেস দিবে আবার নাও দিতে পারে।
 

ব্লকচেইন বাংলাদেশ

বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশও বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।  ব্লকচেইন একটি ফাউন্ডশনাল টেকনোলজি। এটি বর্তমানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ভূমি ব্যবস্থাপনা এমনকি আর্থিক লেনদেনেও আমরা ব্যবহার করতে পারি। সারা বিশ্বজুরেই ব্লকচেইন খুব জনপ্রিয় প্রযুক্তি হয়ে উঠছে। 

 

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ব্লকচেইন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ২০০৯সালে প্রথমবার বিটকয়েন তৈরি হবার পর তখন থেকেই ব্লকচেইন অনেকটা বিবর্তন ঘটে চলেছে। ব্লকচেইন আর্থিক লেনদেনকে অনেক নিরাপদ করে তুলেছে। সেইসাথে অল্প খরচে লেনদেনের ব্যবস্থা করছে। 

 

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে ব্লকচেইনের ব্যবহার হচ্ছে। শাহজালাল ইউনিভার্সিটি সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি উনারাও ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এছাড়া পোশাক খাত এবং ভূমি ব্যবস্থাপনাতেও ব্লকচেইন ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

 

পরিশেষে

পরিশেষে বলা যায় ব্লকচেইন বাংলাদেশে একটি সম্ভবনাময় প্রযুক্তি। ডিজিটাল ব্যাংকিং এর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আশা করি এই আর্টিকেল থেকে ব্লকচেইন কি এই সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পেয়েছেন। যে কোনো প্রয়োজনে বা কোনো মন্তব্য করতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *