বর্তমানে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে বসবাস করছি, আর এই ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি পূর্ব শর্তই হচ্ছে অবাধ বিদ্যুৎ এর ব্যবহার। কেননা বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা কোন প্রযুক্তিই ব্যবহার করতে পারবোনা। এরই পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এর কাজ শুরু করে। আজ আমরা এই আর্টিকেলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এর অবস্থান
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাজশাহি বিভাগের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার অন্তগত পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে অবস্থিত। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এর পাশেই রয়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতু।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এর ইতিহাস
সর্বপ্রথম ১৯৬১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। ১৯৬২ সালেই রূপপুর কে এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য আরো ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
১৯৬৮ সালের মধ্যে বৈদ্যুতিক উপ-কেন্দ্র, ভূমি উন্নয়ন, রেস্ট হাউজ, অফিস ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজ আংশিক সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু ১৯৬৯ সালে ২০০ মেগাওয়াটা বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রকল্পটি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।
দেশ স্বাধীন হবার পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহন করে। পরবর্তীতে একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১২৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্ত বিভিন্ন কারণে পরবর্তীতে এটি আর আর বাস্তবায়ন হয়নি।
১৯৮৭ সালে জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডের দুইটি কোম্পানি কর্তৃক পুনরায় সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করা হয়। এবং এটি ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ
২০০৯ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যবলী ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয়। ২০১০ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সরকার এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি শান্তপূর্ণ ব্যবহারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়াকিং গ্রুপ ও ৮টি উপগ্রুপ গঠন করা হয়।
২০১০ সালের ১০নভেম্বর, জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর, বাংলাদেশ এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তরাষ্ট্রিয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিতদ হয়।
২০১২ সালের ১৯ জুন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ পাশ করা হয়। অবশেষে ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রকল্পটির নির্মান কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা সংস্থা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বিধান সহ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন-২০১৫ জারী করা হয়। ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর, প্রকল্পের কার্যবলী সম্পাদনের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সাধারণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ১নং ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের উদ্বোধন করেন। ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর, বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান গ্রহণ করে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। আর এই মন্ত্রণালয়টি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সকল কাজ বাস্তবায়ন করে আসছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কত মেগাওয়াট
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুইটি (NPP) ইউনিট অন্তর্ভুক্ত থাকবে, এগুলো হলো রূপপুর ইউনিট-১ এবং রূপপুর ইউনিট-২। প্রতিটি ইউনিটের ক্ষমতা হলো ১.২ গিগাওয়াট। অর্থাৎ এই কেন্দ্র থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।
নির্মাণ ব্যয়
এই প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় হিসেবে খরচ হচ্ছে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এর মধ্যে রাশিয়াই ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার সফ্ট লোন হিসেবে দিবে। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প।
যেহেতু এটি একটি turnkey project, তাই সময় বাড়ালেও এর খরচ বাড়বেনা বলে মন্তব্য করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। [1]
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ নির্মাণে সন্তুষ্টি
২০১৭ সালের ৩ জুলাই, Yukiya Amano রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি এই প্রকল্পটি সকল আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।
২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট, বাংলাদেশ সরকার এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে রাশিয়ান ফেডারেশনে ব্যয়িত পারমাণবিক জ্বালানী ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পারমাণবিক জ্বালানি আসলেও রূপপুর কেন্দ্র চালু হতে দেরি কেন
আমাদের অনেকের মনেই হয়তো এই প্রশ্ন জাগতে পারে যে জ্বালানি চলে আসার পরও কেন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হচ্ছেনা। প্রাথমিকভাবে প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলেও সেই পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হয়েছে।
রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরেনিয়াম পাওয়ার পর এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পারমাণবিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। এই প্রকল্পের কোন একটি অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, প্রকল্পটি পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায় চালু হবে ২০২৬ সালে।
পারমাণবিক কেন্দ্র চালু না হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হলো এ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কিন্তু সেই গ্রিডলাইনের নির্মাণ কাজ সময়মত হয়নি।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অন্যতম পূর্বশর্ত হলো, অবিরাম বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা। তাই যদি গ্রিডের লাইন ঠিক না হয় তাহলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবকিছু প্রস্তুত থাকলেও চালু করা সম্ভব না। [2]
কতটা উপকারি হবে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এই প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হয়। সমীক্ষায় দেখা যায় এই প্রকল্প থেকে ১ মার্কিন ডলার খরচ করে ১.৫৮ মার্কিন ডলার সমমূল্যের লভ্যাংশ পাওয়া যাবে।
আশা করা যায় এটি বাংলাদেশের জিডিপিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও এই প্রকল্প অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এসকল বিষয় হিসেব করলে দেখা যায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক লাভ হবে ৭১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এটি দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এতে করে অঞ্চলভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমে আসবে।
পরিশেষে
দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা, জ্বালানি সরবরাহের নিরাপত্তা এবং পরিবেশের ভারসম্য রক্ষায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এর মাধ্যমে যেমন দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে, একইভাবে এটি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে ভালো একটি ধারাণা পেয়েছেন। এছাড়াও যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
রেফারেন্স
Kabir, Ahmed Humayun. “Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in December.” The Daily Star, 27 April 2024, https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/news/rooppur-nuclear-power-plant-first-unit-start-production-december-3596116. Accessed 3 August 2024.
- “পারমাণবিক জ্বালানি আসলেও রূপপুর কেন্দ্র চালু হতে দেরি হবে কেন?” BBC, 6 October 2023, https://www.bbc.com/bengali/articles/cm5keyv188yo. Accessed 3 August 2024.