হ্যাকিং কাকে বলে? হ্যাকিং থেকে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করবেন

আমরা সবাই মোটামুটি হ্যাকিং বা হ্যাক শব্দটার সাথে পরিচিত। কেউ কেউ হয়তো নিজেই হ্যাকিং এর ভুক্তভোগি হয়েছে। অথবা আমাদের পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্নভাবে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন। কারো আবার ফেসবুক বা ইমোর মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি হ্যাক হয়ে গিয়েছে। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা হ্যাকিং কাকে বলে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

হ্যাকিং কাকে বলে

হ্যাকিং হলো একটি কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্কের দূর্বলতা সনাক্ত করে উক্ত ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া। এটা নিয়ন্ত্রণ সাধারণত ব্যক্তিগত ডাটা বা অর্গানাইজশনের ডাটা অ্যাক্সেস করার জন্য নেওয়া হয়ে থাকে। 

 

হ্যাকিং শব্দটা শুনলে ভয় লাগলেও এটি সবসময় মন্দ কাজে ব্যবহার করা হয়না। তবে এটি সাইবার অপরাধের সাথে যুক্ত হবার কারণে এর নেতিবাচক শব্দই বেশি পরিচিত হয়েছে।

 

হ্যাকিং এর প্রকারভেদ

হ্যাকিং কাকে বলে এটা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে হ্যাকিংয়ের প্রকারভেদ সম্পর্কে।  হ্যাকিং প্রধানত তিন প্রকার যথা-

হোয়াইট হ্যাক হ্যাকিং: এটি একটি নিরাপত্তা পরীক্ষা যেখানে কোম্পানি বা সংস্থার অনুমতি সাপেক্ষে হ্যাকাররা তাদের সিস্টেমের দুর্বলতা শনাক্ত করে। এই ধরনের হ্যাকিং ক্ষতিকারক নয়, বরং এর মাধ্যমে বড় কোন হ্যাকিং থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। 

ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকিং: এটি অবৈধ হ্যাকিং কার্যক্রম যা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, অর্থনৈতিক ক্ষতি, মালিকানা ক্ষতি বা অন্যান্য অপরাধের উদ্দেশ্যে করা হয়। এই  হ্যাকিং ক্ষতিকারক হ্যাকিং এর অন্তর্ভুক্ত।

গ্রে হ্যাট হ্যাকিং: এই হ্যাকিংকে ভালো বা খারাপ উভয় দৃষ্টিতেই দেখা যেতে পারে। এরা বিভিন্নভাবে অনলাইনে বিভিন্ন নীতি লঙ্ঘন করার চেষ্টা করে কিন্তু কোন প্রকার ক্ষতি বা আর্থিকভাবে উপকৃত হওয়ার আশায় করেনা। তারা কোন সিস্টেমের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সচেতনতা তৈরি করে। কিন্তু তারা সেটি প্রকাশ্যে করে থাকে।

সুতরাং হ্যাকিং শব্দটি ভালোএবং মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।হ্যাকিং কাকে বলে এটি জানার জন্য এই ভিন্ন প্রকার হ্যাকিং বুঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হ্যাকিং কেন করা হয়

হ্যাকিং করা হয় বিভিন্ন কারণে। কিছু হ্যাকার তাদের দক্ষতা দেখাতে চায়। তারা নতুন প্রযুক্তি বা নিরাপত্তা ব্রেক করে দেখায়।

অন্যদিকে, অনেক হ্যাকার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার জন্য হ্যাকিং করে। এর মাধ্যমে তারা হ্যাকিংয়ে শিকার হওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ দাবি করে। 

রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য নিয়েও হ্যাকিং করা হয়। কিছু হ্যাকার সরকারের নীতি পরিবর্তন করতে চায়। তারা সেই উদ্দেশ্যে হ্যাকিং করে।

অন্যদিকে, কতিপয় হ্যাকার সামাজিক বা রাজনৈতিক সংস্কার আনার জন্য হ্যাকিং করে।

 

হ্যাকিং প্রযুক্তির বিকাশে অবদান রাখতে পারে, কিন্তু এর ক্ষতিকর ব্যবহার প্রতিরোধ করাও খুব বেশি প্রয়োজন। 

হ্যাকিং এর ক্ষতিকারক দিকগুলি

ক্ষতির উদ্দেশ্যে হ্যাকিং একটা বড় সমস্যা। এটা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে পারে। এছাড়াও এটা অর্থনৈতিক ক্ষতি করে থাকে। 

 

হ্যাকাররা আমাদের নাম, ঠিকানা, পাসওয়ার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড বিবরণ চুরি করে। তারা আর্থিক লেনদেন এবং অনলাইন অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেক করতে পারে।

ব্যক্তিগত তথ্য চুরি

হ্যাকাররা আমাদের নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি পাসওয়ার্ড চুরি করে থাকে। এই তথ্য দিয়ে তারা ক্রেডিট কার্ড ফাঁকা করে দিতে পারে।

 

তারা আপনার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে অনায়েসে নিজের জন্য শপিং করতে পারে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি

হ্যাকাররা আপনার অনলাইন লেনদেনের প্রক্রিয়া ভেঙ্গে দিতে পারে। তারা বিনা অনুমতিতেই অনলাইন অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারে আর্থিকভাবে ক্ষতি করতে পারে। 

বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরকে হ্যাকিং কার্যক্রমগুলো বড় ধরনের হুমকিতে ফেলতে পারে। যেমন ২০১৬ সালের ৪ ই ফ্রেব্রুয়ারী রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৮কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়ে যায়। [সূত্র যুগান্তর

 

তাই হ্যাকিং থেকে বাচার উপায় এবং হ্যাকিং এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরী।

কোন কোন ক্ষেত্রে হ্যাকিং ভালো হতে পারে

হ্যাকিং শব্দটি দুই ভাগে ভাগ করা যায় – একটি ইথিক্যাল হ্যাকিং আরেকটি আন ইথিক্যাল হ্যাকিং। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা স্বার্থেও হ্যাকাররা কাজ করে থাকে। এই কাজে বিশেষজ্ঞ হ্যাকারদের সাহায্য নেয়া হয়।

সংগঠনগুলি নিজেদের নিরাপত্তা চেক করার জন্য এই হ্যাকারদের নিয়োগ দেয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়মিত সাইবার নিরাপত্তা পরীক্ষা করে। এটা তাদের ডিজিটাল অবকাঠামো সুরক্ষিত রাখে।

এই হ্যাকিং এর উদ্দেশ্য হল দুর্বলতা খুঁজে বের করা এবং প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষায় শক্তিশালী করা। এটা আইনসম্মত এবং নৈতিক হিসাবে বিবেচিত হয় আর একেই ইথিক্যাল হ্যাকিং হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 

 

সাম্প্রতিককালে কিছু কোম্পানি তাদের অবকাঠন পরীক্ষা করার জন্য হ্যাকারদের সাহায্য নিচ্ছে। এটা তাদের সেবা এবং পরিষেবাকে ভালোভাবে সুরক্ষিত করে। এই ধরনের হ্যাকিংগুলি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে করা হয়ে থাকে। তারা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বাড়াতে সাহায্য করে ফলে তাদের এই কাজ সমাজে এবং দেশে অনেক বড় অবদান রাখে।

হ্যাকিং এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ

বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করে আমরা হ্যাকিং থেকে বাচঁতে পারি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিরাপদ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা এবং ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করা।

নিরাপদ পাসওয়ার্ড ব্যবহার

আমাদের প্রত্যেকের জন্যই পাসওয়ার্ড নিরাপদ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাকিং থেকে বাঁচতে নিম্নলিখিত নিয়ম অনুযায়ী নিরাপদ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা উচিত। 

 

  • পাসওয়ার্ডের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৮ সংখ্যা বা লেটার ব্যবহার করা উচিত। 

  • বড় অক্ষর, ছোট অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ চিহ্নগুলি মিশিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করুন।

  • একই পাসওয়ার্ড বহুবার ব্যবহার না করে আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।

  • নিয়মিত ভাবে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন।

ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার

বর্তমানে আপনারা অনেকেই এই ভিপিএন সম্পর্কে জেনে থাকবেন। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করলে আপনার ইন্টারনেট ট্র্যাফিক গোপন থাকে। আপনি কোথায় থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন এটা জানা যায়না তাই এটা হ্যাকিং থেকে রক্ষা দেয়। ভিপিএন আপনার ব্রাউজিং ইতিহাস এবং নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক সম্পূর্ণ গোপন রাখে।

সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার উপায়

হ্যাকিং থেকে বাঁচার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পদক্ষেপগুলি আপনার ডিভাইস এবং তথ্য সুরক্ষিত রাখবে।

প্রথমে, আপনার কম্পিউটারে অ্যান্টি-ভাইরাস সফ্টওয়ার ইনস্টল করুন। এবং নিয়মিত আপডেট করুন। এটি আপনাকে হ্যাকিং এবং ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিবে।

দ্বিতীয়ত, সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। এবং নিজের তথ্য নিরাপদ রাখার জন্য সর্বদা সতর্ক থাকুন। এমন ইমেল বা লিঙ্ক খুলবেন না যা সন্দেহজনক মনে হয়।

  1. নিয়মিত ব্যাকআপ নেওয়া

  2. টু ফ্যাক্টর ভ্যারিফিকেশন অন করা

  3. সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সাথে যোগাযোগ রাখা

 

এই পদক্ষেপগুলি আপনাকে হ্যাকিং এবং অন্যান্য সাইবার হুমকি থেকে সুরক্ষা দিবে।

হ্যাকিং থেকে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করবেন

বর্তমান এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ‍সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকি। একইভাবে এর পাশাপাশি বিভিন্ন নিরাপত্তা ইস্যুও আমাদের থাকে। 

যেমন সাইবার সিকিউরিটি, সাইবার বুলিং, এবং সাইবার অপরাধসহ আরো অনেক কিছু। চলুন আমরা এমন কিছু উপায় সম্পর্কে জেনে নেই যার মাধ্যমে আমরা নিজেকে হ্যাকিং থেকে রক্ষা করতে পারি।

১ম পার্টি সোর্স থেকে ডাউনলোড

আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন সফটওয়্যার ডাউনলোড করার প্রয়োজন পরে। অনেকে না বুঝে যেকোনো ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করতে গিয়ে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে যায়। তাই আমাদের উচিত ডাউনলোড করার সময় উক্ত সফটওয়্যারের প্রধান সোর্স থেকে ডাউনলোড করা। তাহলে এই ঝুঁকি থাকবেনা।

অ্যান্টিভাইরাস ভাইরাস ব্যবহার করা

আমাদের প্রত্যেকের উচিত সবার ডিভাইসে একটি ভালো মানের অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করা। এটি আপনাকে হ্যাকিং সংক্রান্ত অনেক ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে।

হ্যাকিং প্রতিরোধে ভিপিএন ব্যবহার করা

ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করলে আপনি নিরাপদে ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারবেন। ভিপিএন ব্যবহার করলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য লুকানো থাকে। অর্থাৎ আপনি যদি বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাহলে ভিপিএনের মাধ্যমে আপনি যেকোনো দেশের লোকেশন ব্যবহার করতে পারবেন।

পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার

যেকোনো অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেই আমাদের উচিত শক্তিশালি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা। কিন্তু হঠাৎ করে একটি শক্তিশালি পাসওয়ার্ড তৈরি করে সেটি আবার মনে রাখা বেশ কঠিন। অনেকে আবার পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েও নানা সমস্যায় পরে থাকেন। তাই আমাদের উচিত পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করা। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের যাবতীয় পাসওয়ার্ড ম্যানেজ করতে পারি।

হ্যাকিং প্রতিরোধে টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ব্যবহার করা

ব্যাপারটা যখন নিরাপত্তার তখন টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন অবশ্যই এগিয়ে থাকবে। বর্তমানে এটি খুবই জনপ্রিয় একটি সিকিউরিটি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে একটি অ্যাকাউন্ট দুইভাবে নিরাপত্তা পরীক্ষা করে থাকে প্রথমত পাসওয়ার্ড এর মাধ্যমে দ্বিতীয়ত ওটিপি বা গুগল ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে। তাই এটিকে অনেক নির্ভরযোগ্য হিসেবে ধরা হয়।

পরিশেষে

আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমরা বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকি, আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। একইভাবে এর কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়া। এর মাধ্যমে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারি, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে পারি। তাই আমাদের উচিত হ্যাকিং কাকে বলে বিষয়টি জানা এবং মেনে চলা। 

আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনি হ্যাকিং কাকে বলে এই সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদের সর্বোত্মক চেষ্টা থাকবে আপনাকে সহযোগিতা করার।

Leave a Comment