তথ্য প্রযুক্তি

ইলেকট্রিক চুলা কি? এটি কেন ব্যবহার করবো

বর্তমানে আমরা আধুনিক বিশ্বে বসবাস করছি। আমাদের জীবনযাত্রার মানও দিন দিন উন্নত হচ্ছে। আমাদের চারপাশের সবকিছুতেই যেন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এটি বাদ যায়নি রান্নাঘরেও। পূর্বে যেখানে আমরা মাটির চুঁলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করতাম সেখানে আজ আমরা গ্যাস এবং গ্যাস ছাড়িয়ে বিৎদ্যুতের সহায়তাও রান্না করছি। আর সেটা সম্ভব হয়েছে ইলেকট্রিক চুলা এর কারণে। এই আর্টিকেলে আমরা ইলেকট্রিক চুলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

 

ইলেকট্রিক চুলা কি

সর্বপ্রথম ১৮৯২ সালে একটি কানাডিয়ান বৈদ্যুতিক কোম্পানি দ্বারা এই বৈদ্যুতিক চুলা আবিষ্কার হয়েছিলো। পরবর্তীতে খুব শীঘ্রই এই চুলাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কারন এগুলি পরিষ্কার করা সহজ, কম ব্যয়বহুল এবং দ্রুত রান্না করা যায়। 

 

তবে দেখা যায় যে গ্যাসের চুলাও অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিগত বছরগুলিতে। কেননা অনেকের মতামত যে ইলেকট্রিক চুলার চেয়ে গ্যাসের চুলা অনেক দ্রুত খাবার গরম করতে পারে। 

 

তবে ২০১৮ সালে আমেরিকায় Energy Information Administration এর করা একটি জরিপে দেখা যায় যে আমেরিকায় প্রায় ৬৩ শতাংশ মানুষ ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করে। 

 

ইলেকট্রিক চুলা সাধারণত তিন ধরনের কয়েল টপ, গ্লাস টপ এবং ইন্ডাকশন। কয়েল টপ এবং গ্লাস টপ এর চুলাগুলি একইভাবে কাজ করে। উভয় ক্ষেত্রেই, প্রতিটি বার্নার স্বাধীন সার্কিটের মত কাজ করে। 

 

যখন চুলাগুলি চালু হয় তখন ১২০ভোল্ট বিদ্যুৎ সার্কিটের মধ্য দিয়ে চলে এবং তাপ উৎপন্ন করতে কয়েলে একত্রিত হয়। শুধুমাত্র পার্থক্য আসে যে তারা প্যান এর সাথে কিভাবে সংযোগ করে। একটি কয়েলের উপরিভাগে একটি ‍উন্মুক্ত ধাতব কয়েল থাকে। যেখানে একটি রেডিয়ান্ট চুলার উপরিভাগে একটি সমতল কাঁচ বা সিরামিকের উপরিভাগের নিচে একটি কয়েল লুকানো থাকে।  

 

এদিকে, ইন্ডাকশন স্টোভ একটি একটি সিরামিক বা কাঁচের পৃষ্ঠের নিচে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক কয়েল ব্যবহার করে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক কয়েলগুলি শুধুমাত্র তাপ উৎপন্ন করে। যখন সেটি লোহার সংস্পর্শে আসে যা চৌম্বকীয় প্রতিরোধের মাধ্যমে সার্কিট বন্ধ করে দেয়। এর মানে হলো কয়েলে তাপ উৎপন্ন করে প্যানে ট্রান্সফার করার পরিবর্তে চুলাটি নিজেই প্যানে তাপ উৎপন্ন করে।

 

ইলেকট্রিক চুলা এবং গ্যাসের চুলার পার্থক্য

আপনার পছন্দের খাবার রান্না, সিদ্ধ বা ভাজার জন্য চুলা সাধারণত চার থেকে ছয়টি বার্নার দিয়ে তৈরি। গ্যাসের চুলা সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়  ১৮৩৪ সালে। পূর্বে রান্না করতে যেখানে অনেক বেশি কাঠ কয়লা বা লাকড়ির ব্যবহার করা হতো। কিন্তু গ্যাসের চুলার মাধ্যমে এগুলির পরিবর্তে গ্যাস ব্যবহার করেই রান্না সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। 

 

একটি গ্যাস লাইন বার্নারের সাথে সংযোগ করা থাকে। যখন আপনি চুলার গাঁটটি ঘুরিয়ে দেন, তারমানে আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস ছেড়ে দেন। বেশিরভাগ চুলায় বৈদ্যুতিক ইগনিশন থাকে, যাকে অটো চুলাও বলা হয়। অর্থাৎ আপনি যখন চুলার গ্যাস লাইনটি অন করবেন তখন সয়ংক্রিয়ভাবে চুলায় আগুন জ্বলে উঠবে।

 

চুলা কিভাবে রান্নাকে প্রভাবিত করে

প্রতিটি চুলারই কিছু সুবিধা অসুবিধা রয়েছে হোক সেটা গ্যাসের চুলা, কয়েল টপ, গ্লাস টপ বা ইন্ডাকশন। কেউ কেউ মনে করেন রান্নার জন্য গ্যাসের চুলাই বেশি ভালো কারণ হিসেবে তাদের ধারণা তাপের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। চুলার knob ঘোরালেই তাপ ও কম বেশি হয়। 

 

অপরদিকে তেল এবং কাচেঁর চুলার ক্ষেত্রে এই চুলাগুলি অনেক ধীরে ধীরে তাপ উৎপন্ন করে কেননা কয়েলগুলিকে ঠান্ডা বা গরম হতে হয়। কয়েলগুলি একবার বন্ধ হয়ে গেলেও তাপ ধরে রাখে যা পোড়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমনটা আমরা আইরন করার সময় আইরন মেশিনে দেখি। 

 

তবে এসব দিক থেকে ইন্ডাকশন চুলা ই সেরা। এটি রান্নার পাত্রে সরাসরি তাপ সরবরাহ করে, এটি থেকে দ্রুত তাপ উৎপন্ন হয় আবার চাইলেই মূহুর্তের মধ্যে তাপ শুন্য অবস্থানে নেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ এখানে যেমন ক্ষতি বা পোড়ার আশঙ্কা কমায় তেমনিভাবে পরিষ্কার করাও সহজ করে তোলে।

 

ইন্ডাকশন  চুলায় কি সব ধরনের পাতিল ব্যবহার করা যায়

ইন্ডাকশন  চুলা দিয়ে আপনি কম সময়ে, কম বিদ্যুৎ খরচে সব কিছু রান্না করতে পারবেন কিন্তু এর একটি বিরক্তিকর ব্যপার হলো এতে সব ধরনের পাতিল বসানো যায়না। 

 

যে সব পাতিলের নিচে চুম্বক ধরলে আটকে থাকে পড়ে যায় না, সেই সব পাতিলই কেবল আপনি ইন্ডাকশন চুলার জন্য ব্যবহার করতে পারবেন। কেননা এই চুলা কয়েল গরম করে তাপ উৎপন্ন করে না। এটি রেডিয়েশন উৎপন্ন করে পাতিলের তলাতে গরম ছড়ায়। আবার পাতিলটি সরিয়ে নিয়ে চুলা সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যে সব পাতিলে চৌম্বক আকর্ষন করেনা সেগুলো চুলায় দিলে তা কখনো গরম হবেনা। 

 

এমনকি আপনি যদি ইন্ডাকশন চুলায় হাতও রাখেন তাতে হাত পুড়বেনা, কারণ কেবলমাত্র চুম্বকের সংস্পর্শে এলেই সেটি চালু হয়। তাই ইলেকট্রিক চুলাগুলির মধ্যে ইন্ডাকশন চুলাই হলো সবচেয়ে নিরাপদ চুলা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। আমরা এটিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হিসেবেও ধরতে পারি। 

 

ইলেকট্রিক চুলা কি স্বাস্থ্যের উপর কোনো প্রভাব ফেলে

যে কোনো চুলার জন্য এর ধোঁয়া হলো এর নেতিবাচক দিক। আমরা বাসা বাড়িতে যেসব লাইনের গ্যাস বা সিলিন্ডিার গ্যাস ব্যবহার করি এটাতে মিথেন এবং নাইট্রোজেন গ্যাস থাকে। যা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় লিক হয়ে যায়। এই রাসায়নিকগুলি আমাদের স্বাস্থ্য এবং আমাদের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। 

 

যখন পুরো পৃথিবী নিয়ে কথা আসে সেখানে মিথেন গ্যাস সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। আমরা জানি যে মিথেন একটি শক্তিশালিী গ্রিনহাউস গ্যাস (GHG), প্রাকৃতিক গ্যাসের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ, যা গ্যাসের চুলার জন্য প্রধান জ্বালানী। 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাস স্টোভ যে পরিমাণ পরিমাণ জলবায়ুর উপর প্রভাব ফেলে তা বছরে ৫০০,০০০ গাড়ি থেকে নির্গমনের সমান। আপনি যদি রান্না পছন্দ করে তবে এই পরিসংখ্যানটি আপনাকে ভাবাবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জন্য এমনকি পুরো বিশ্বের জন্য হুমকি। 

 

আমরা জ্বালানী হিসেবে যে নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) ব্যবহার করি সেটা আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ। শুধু ফুটন্ত পানি প্রতি বিলিয়ন (ppb) Nox এর ১৮৪ অংশ উৎপন্ন করে। এটার কারণে শৈশবকালীন হাঁপানির ঝুঁকি বাড়ায়, শ্বাসনালীকে জ্বালাতন করে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা হ্রাস করে এবং মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করে।

 

ইলেকট্রিক চুলা কেনার সঠিক সময়

আপনি যদি আপনার এই সুন্দর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে চান এবং অর্থ সঞ্চয় করতে চান, তবে এখনই আপনি ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করা শুরু করতে পারেন। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সরকার ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহারে পরামর্শ দিচ্ছেন। মার্কিন সরকার ইলেকট্রিক চুলাসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিগুলিতে ছাড়ের জন্য $4.5 বরাদ্ধ রেখেছে। বাংলাদেশেও ইলেকট্রিক চুলার ব্যবহার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। 

 

এছাড়াও বাংলাদেশে গ্যাস সংকটের কারণে ২০০৯ সাল থেকে  সারা দেশে নতুন আবাসিক গ্যাস-সংযোগ বন্ধের নির্দেশ দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের জ্বালানি বিভাগ। এবং এটি ২০১৭ সাল থেকে পালিত হচ্ছে। বর্তমানে বাসাবাড়িতে এখন কোনো গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সূত্র: প্রথম আলো

 

ইলেকট্রিক চুলা এর দাম

বর্তমানে বিভিন্ন কোয়ালিটির বিভিন্ন দামের ইলেকট্রিক চুলা পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চুলা বাজারে আছে যেমন ভিশন, ফিলিপস, কিয়াম, গাজি, বাজাজ, ওয়ালটন, মিয়াকো ইত্যাদি। তবে সার্বিকভাবে আপনি ১৫০০ থেকে ৯৫০০ এর মধ্যে সকল ধরনের ইলেকট্রিক চুলা পেয়ে যাবেন।  

 

চুলাগুলির দাম বিভিন্ন সময়ই পরিবর্তীত হয়, তাই নিকটস্থ দোকানে গেলে বর্তমান এবং অফার প্রাইস সম্পর্কে জানতে পারবেন। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী যে আপনি যদি ইলেকট্রিক চুলার ক্ষেত্রে ইন্ডাকশন চুলা ক্রয় করেন তবে অবশ্যই এই চুলার জন্য চৌম্বক আকর্ষন করে এমন পাতিলও ক্রয় করতে হবে। তাই বাজেটের ক্ষেত্রে এটি বিবেচনায় রাখা উচিত।

 

পরিশেষে

তাই আপনি যদি নতুন সংসার শুরু করেন বা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নামতে চান সেক্ষেত্রে অবশ্যই রান্নার যন্ত্রপাতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এতক্ষনে আমরা জানতে পারলাম যে গ্যাসের চুলার কারনে নানাভাবে জলবায়ুর উপরে প্রভাব পরছে। ইলেকট্রিক চুলা ডিজিটাল প্রযুক্তির বড় একটি অবদান। 

 

তবে একটা বিষয় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ইন্ডাকশন চুলা ইলেকট্রিক চুলার গুণগতমানকে উন্নত করেছে। এটি ব্যবহারে যেমন আপনি অতি দ্রুত রান্না করতে পারবেন, অতি দ্রুত পরিষ্কার করতে পারবেন একইভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরির্তনের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে নিজেরা ভূমিকা রাখতে পারবো। 

 

ধন্যবাদ সকল পাঠককে এই আর্টিকেলটি পড়ার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *